বর্তমান সময়ে পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশনের সংবাদ, যেদিকেই তাকাই না কেন একটি খবর যেন সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে; "ধর্ষণ"। বর্তমানে এমন কোনো দিন আমরা দেখতে পাইনা, যেদিন আমাদের সমাজের নারীরা ধর্ষণের শিকার হন না। নারীসমাজ যেন কোথাও নিরাপদ নয়। নিজ বাসা, কর্মস্থল থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা, কেউই যেন ধর্ষণের থাবা থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না। কিন্তু সমাজের এত অধঃপতন কেন? তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? এত এত ধর্ষণের সংবাদের মাঝে আমরা বিচার পাই কতগুলোর? কেনই বা ধর্ষকেরা মুক্তি পেয়ে যায়? বিচার ব্যবস্থার গাফিলতির কারনে সমাজের অমানুষ শ্রেণীর তাণ্ডব যেন দিনদিন বেড়েই চলেছে। বর্তমান বাংলাদেশ যেন ধর্ষকদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। বিচারহীনতা তাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় রীতিমতো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গত কয়েক বছরে ধর্ষণের অবস্থা দেখলে জানা যায়, ২০১০ সালে সারাদেশে ৫৯৩ জন, ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন, ২০১৪ সালে ৭০৭ জন, ২০১৫ সালে ৮৪৬ জন, ২০১৬ সালে ৭২৪ জন, ২০১৭ সালে ৮১৮ জন, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১৪১৩ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ছিল এককভাবে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ চেষ্টা।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫৪৬ জন নারী। ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১৫ জন। এছাড়া শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৭৪ জন। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ১০৮ জন নারী ধর্ষণের শিকারসহ ২৫৯ জন নারী ও কন্যাশিশু শিকার হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গত ৫ মাসে যেন এসব ঘটনা বেড়েই চলেছে। তবে সব ঘটনা সামনে না আসায় ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা এসব পরিসংখ্যানের চেয়ে আরও অনেক বেশী বলে মনে করেন নারী অধিকার কর্মীরা। মহামারীর এই সময়েও গেল এপ্রিল মাসে দেশে ৩৭১টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ধর্ষণ ১৩৭টি, দলবদ্ধ ধর্ষণ ৩১টি, প্রতিবন্ধী শিশু কিশোর ধর্ষণ ৯ জন। ১লা মে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন এ তথ্য জানায়।
ধর্ষনের কারন হিসাবে বিপুল সংখ্যক লোকজন মেয়েদের পোশাককে দায়ী করছে যেটা কখনোই গ্রহনযোগ্য নয়। যা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় ধরনের বাধা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সময় দেখা যায় মানুষের এমন হীন মতামত যা নারী স্বাধীনতার পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে দৈনিক গড়ে চারটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ধর্ষণের শতকরা মাত্র তিন ভাগ মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনো বাংলাদেশে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা অনেকটাই অকার্যকর, যার কারণে ধর্ষকের মনে ভয়ভীতির পরিমাণ কম লক্ষ্য করা যায়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো থেকে ধর্ষণের প্রতিবেদনগুলো পাওয়া যায় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নিনা গোস্বামী জানায়- থানায় মামলা হলেও সব ধর্ষণের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসে না। আবার অনেক ঘটনার মামলাও হয় না।
ধর্ষণের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসমস্ত ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সে তুলনায় বাড়ছে না বিচার। কিছু মামলায় নিম্ন আদালতে বিচার হলেও শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতে আটকে যায়। আপিলের নামে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। ফলে দেখা যায় এক যুগেও বিচার শেষ হয় না। ধর্ষণ মামলার আসামিরা নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়ান। আইনের ফাঁক গলিয়ে ছাড়া পাওয়া আসামিরা নতুন তাণ্ডব শুরু করেন। ভিক্টিমের পরিবারে তখন নেমে আসে নতুন বিপদ।
ধর্ষনের জনক্স মেয়েদের পোশাক নয় বরং দায়ী শুধুমাত্র ধর্ষক এই চিন্তা চেতনা সমাজে না আনতে পারলে ধর্ষন রোধ করা সম্ভব হবে না।
২০১৭ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলে বাসে রূপা খাতুন ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত দ্রুতই রায় দেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৪ জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মামলাটি উচ্চ আদালতে আপিলে আটকে আছে। এভাবেই ঝুলে থাকে ধর্ষণ মামলাগুলো। নিম্ন আদালতে রায় হলেও উচ্চ আদালত হয়ে চূড়ান্ত রায় পেতে বছরের পর বছর লেগে যায়। ১৯৯৮ সালে শাজনীন তাসনিম রহমানকে ঢাকায় তার নিজ বাসায় ধর্ষণ করা হয়। এ মামলার রায় পেতে ১৮ বছর লেগে যায়। ২০১৬ সালের আগস্টে একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, যে দেশে ৯৭ ভাগ ধর্ষণের মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যায়, সে দেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা যে প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে তা বলাই যায়।
কতটা অসহায় আমাদের সমাজের নারী, শিশু-কিশোর! বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি দূর করতে নারী নির্যাতনের বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এখন সময়ের দাবী। নানামুখী দাবীর মুখে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে ১২ অক্টোবর "নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০০০, জারি করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। পরে নভেম্বরে জাতীয় সংসদে অধ্যাদেশটি বিল হিসেবে পাশ হয়। যদিও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মতে, শাস্তি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
আইনজীবীদের মতে, দ্রুত বিচারের মাধ্যমে ধর্ষণ মামলার শাস্তি দিতে হবে। যে আইনের প্রয়োগ নেই, শুধু ভয় দেখানোর জন্য এমন আইন দরকার নেই। বাস্তবায়নযোগ্য বিধিবিধান প্রয়োজন। সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি বৃদ্ধি করতে হবে পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক মূল্যবোধ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে ধর্ষণ মামলায় দৃষ্টান্তমূলক নজির সৃষ্টি করতে হবে।